জাগতিক উদ্যান

“আমি আকাশ।

আমি নিত্য মুক্ত।
আমার সব আছে - সমগ্র সৃষ্টিতে যা কিছুর অস্তিত্ব আছে, যা কিছু সম্ভব – সবকিছু। আমার ওপর-ই ভেসে বেড়াছে সূর্য চন্দ্র গ্রহ তারা... আবার সবচাইতে ধনী হওয়া সত্ত্বেও আমি সবচেয়ে বেশী মুক্ত। কারন সবকিছু থাকা সত্ত্বেও আমি ওগুলোর কোনোটাকেই ধরে রাখি না, বেঁধে রাখি না, আর তাই আমাকেও কেউ ধরে রাখতে পারেনা...

আমি চির নতুন।
কখনো ঘন কালো মেঘে ঘোর কৃষ্ণ বর্ণ, কখনো বা রাশি রাশি শুভ্র মেঘের ঢেউয়ে ঢেকে আমি দুধসাগর। বিচিত্র বৈপরীত্য আমার রূপে। রামধনুর সাত রঙ একে একে আসে, একে একে যায়। কিন্তু সে কোনো রূপকেই আমি ধরে রাখি না। আর তাই আমি চির নূতন। প্রকৃত রঙ আমার নীল। নীল হল স্বপ্নের রঙ। স্বপ্নের রঙে রঙিন আমি...

আমি নিয়ত প্রসারণশীল।
সৃষ্টি থেমে থাকে না। সৃষ্টি ক্রমশ বিস্তার লাভ করে চলেছে, আর তাই সমস্ত সৃষ্টিকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য আমিও ক্রমাগত প্রসারিত হয়ে চলেছি। আরো বড়, আরো বড়... আমি প্রতিদিন বড় হই... আকাশ অনন্ত

আকাশ সকলের... আমি সবার... আমি সবাইকে ভালোবাসি...”

মনে মনে একটু একটু কোরে আকাশের চরিত্র টা ভাবি, আর আমার নীল ডায়রী তে নোট করিনা, ঠিক লেখক হওয়ার ইচ্ছে সেরকম ভাবে নেই। তবে আছে পালানোর ইচ্ছে, মুক্তির ইচ্ছে। ইচ্ছে টা আজকের নয়, বহুকাল আগের। বরং এখনকার ইচ্ছে টাকে সেই বহু পুরোনো ইচ্ছের একটা ভয়ঙ্কর রুগ্ণ ছায়ামাত্র বলা যায়...

মনে মনে আমি হয়ত এখনও সেই স্কুলে পড়ার বয়সেই রয়েছি। কিন্তু বাহ্যিক দিক দিয়ে অনেক কাজ বেড়েছে, দায়িত্ব বেড়েছে। এখন আর পালিয়ে যাওয়ার মত খামখেয়ালীপনা করার অধিকার বা স্বাধীনতা, কোনোটাই আমার নেই। তাই কখনো কখনো ছুটির দিনে অলস রোদমাখা দুপুরে বন্ধ জানালার এপাশে বসে উদাসী সুরে, কখনও বা এইরকম ফুরফুরে হাওয়ার পাতাঝরা বিকেলে ছাদে বা পার্কে বসে অতীতের সমস্ত বসন্তের আনন্দে, আবার কখনো কখনো ক্লান্তিকর দিনের শেষে গভীর রাতের নিস্তব্ধতায় গম্ভীর প্রশান্তিতে, আমি বেরিয়ে পড়ি আকাশ হোয়ে – মনে মনে –
“কোথাও আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা –
মনে মনে...”

ছোটোবেলায় স্কুলে পড়ার সময় স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী পড়ি। খুব ভালো লেগেছিল তাঁর পরিব্রাজক জীবন। যেন একটা স্বপ্নের মতন। মনে হতো আমিও একদিন বেরিয়ে পড়বো তাঁর মত, অচেনার বেশে। অজানা জায়গায় ঘুরে বেড়াবো। সমস্ত মানুষের মাঝে ঘুরে বেড়াবো, অথচ কেউ আমায় চিনবে না। আর একটা খোঁজ থাকবে, ঈশ্বরের খোঁজ। ধর্মগ্রন্থগুলিতে বলা আছে ঈশ্বরের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীলতার কথা। বলা আছে ঈশ্বরের জন্য যে মানুষ বের হবে তার সমস্ত দায়িত্ব স্বয়ং ঈশ্বর নেবেন। স্বামীজির পরিব্রাজক জীবনে এমন অনেক ঘটনা-ও আছে, যা এই কথাটার সাথে মিলে যায়, যেন স্বামীজী তার জীবন দিয়ে এ কথার সত্যতা অভিজ্ঞতা করেছেন এবং সকলের কাছে প্রমান করে দিয়েছেন। অলৌকিক নাকি কাকতালীয় জানিনা, তবে ব্যাপারটা রোমাঞ্চকর। আর মনের মত প্রমান পেলে আমি বিশ্বাস করতেই ভালোবাসি... তো সেই ব্যাপারটারও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা করার প্রচণ্ড ইচ্ছে জাগে। শুনেছি ঈশ্বর সব সময় আমাদের সাথে সাথে আছেন, পাশে পাশে আছেন। শুধু কথায় বিশ্বাস নয়, আমি অনুভব করতে চাই।

যাইহোক, সেসব ইছে হওয়ার জন্যও একটা বয়স লাগে, যখন মানুষের মন থাকে কল্পনাপ্রবণ আর মস্তিষ্ক চিন্তাশূণ্য। সেটা ছাত্রজীবন, আর এখন কর্মজীবন। এখন ব্যাপারটা অন্য। এখন পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা মূলত পালানোর তাগিদেই, কোনোকিছু যাচাই বা প্রমান করার জন্য নয়। রোজকার একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য, জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়ার জন্য।

জীবনের অর্থ - হ্যাঁ সত্যি, ছোটোবেলা থেকেই, এই একটা প্রশ্ন আজ-ও এক-ই রকম রয়ে গেছে। কেন মানুষ জন্মায় আর কেনোই বা মরে। সেই কবে থেকে জন্মাচ্ছে আর মরছে। একটা সময় আসবে যখন ডায়নোসর এর মত মানুষ বলেও আর কিছু থাকবে না। বা একটা গল্পের জীব হয়ে থেকে যাবে... এর থেকেই ক্রমশ মন চলে যায় আরো বৃহত্তর ছবির দিকে। সময়ের শুরু কবে? মানে, আমরা জানি আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে পৃথিবীতে প্রথম মানুষের আবির্ভাব হয়, তার-ও হাজার হাজার বছর আগে পৃথিবী সৃষ্টি হয়। এইভাবে সময় ধরে অতীতের দিকে যেতে থাকলে একসময় পাবো সূর্যের জন্ম। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে অতীতের দিকে এই যাত্রার শেষ কোথায়? সময়ের সূচনাকাল বা শূণ্যতম মুহুর্ত কোনটা? বা আদৌ কি এরকম কোনো মুহুর্ত সম্ভব? আমার মনে হয় সম্ভব নয়। কারন যেই কেউ আমায় জানাবে যে এইটা হোলো শূণ্যতম মুহুর্ত, তখন-ই আমি তাকে জিজ্ঞেস করবো, তাহলে তার এক সেকেণ্ড আগের সময়টা কি সময় নয় নাকি?

এ তো গেলো কাল বিষয়ক সমস্যা। অপর যে সমস্যাটা এক-ই রকম জটিল লাগে, সেটা হোলো স্থান বিষয়ক সমস্যা। পৃথিবী, সুর্য, চাঁদ ইত্যাদি সবাই ভেসে আছে শূন্যে – যাকে বলা হয় মহাশূণ্যকিন্তু সেই শূণ্যস্থানটাই বা কতোটা স্থান জুড়ে রয়েছে? আমরা জানি যা কিছুর শুরু আছে, তার একটা শেষ আছে। যেমন ঘরের মধ্যে যদি শূণ্যস্থান সৃষ্টি করা হয়, তাহলে তার সীমা এ দেওয়াল থেকে ও দেওয়াল অব্ধি। কিন্তু তাহলে এই মহাশূণ্যের দেওয়াল কোথায়? অর্থাৎ কেউ যদি অবিরাম একদিকে হেঁটে যেতে থাকে, তাহলে কখনো তো, কোথাও তো একটা ধাক্কা খাওয়ার কথা, যেখানে পথ শেষ হবে? তা না, এ ও যেন, সেই কাল বা সময় এর মত-ই অনন্ত, কালের মত স্থান এর ও যেন কোথাও কোনো শুরু বা শেষ নেই। আর যদি কোনো অনুসন্ধানী ব্যক্তি এরম কোনো দেওয়াল খুঁজে বের ও করেন, যা গোল কোরে এই মহাশূণ্য কে দশদিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে, তাহলে আমার প্রশ্ন, ওই গোলোকের বাইরে কি আছে?

এসব বড় ভাব্বার বিষয়। এত জটিল ভাবনার উত্তরশুধু যে ভেবে ভেবেই মাথা থেকে বের কোরে ফেলবো, এমন মাথা ভগবান আমায় দেন নি। তাই এইসব নিয়ে ভাবতে বসলেই মাথাটা কেমন যেন গোল পাকিয়ে যায়, কম্পিউটার হ্যাং হোয়ে যাওয়ার মত।

যাক সে সব ভাবনার কথা। এখানে আমি আসি মাথা হাল্কা করার জন্য। কিন্তু মাথার কাজ-ই যেনো নিয়ত চিন্তা কোরে যাওয়া, তাই একটু হাল্কা হলেই আবার অন্য চিন্তায় লেগে যায়।
এখন যেখানে বসে আছি সেটা একটা শিশু উদ্যান। অদ্ভুত জায়গা, শান্তির জায়গা। মানুষের শৈশব আর প্রৌঢ়ত্ব এখানে হাত ধরাধরি কোরে হেঁটে বেড়ায়। আজ যেসব বাচ্ছারা এখানে দৌড়ে লাফিয়ে ধুলোয় লুটোপুটি কোরে খেলে বেড়াচ্ছে, এই জায়গা টাকে এত ভালোবাসছে, এবং কোনো একদিন না আসতে পারলেই হয়ত বাড়িতে বায়না জুড়ে দেয়, কান্নাকাটি করে, তারা আস্তে আস্তে বড় হবে। তখন তাদের সাথে এই শিশু উদ্যানের কোনো সম্পর্ক থাকবে না। তারা নিজেদের জীবনে ব্যস্ত হোয়ে পড়বে। ভুলে যাবে তাদের প্রিয় উদ্যানটিকে। আর এইভাবে কেটে  যাবে অনেকগুলো দিন, অনেক গুলো বছর। সময়ের চাকা দ্রুত ঘুরে যাবে... আর তারপর একদিন, এইরকম-ই এক সুন্দর বিকেলে, তারা আবার, হ্যাঁ আবার, পা বাড়াবে এই শিশু উদ্যানের দিকে। নাতি বা নাতনির হাত ধরে। আজ যেখানে তাদের দাদু দিদা ঠাম্মা রা বসে আছেন, সেই জায়গা হবে তাদের। আজকের মত সেদিনও নিষ্পাপ শিশুদের প্রাণ খোলা হাসি ও স্বাধীন খেলাধুলার আনন্দ প্রৌঢ়দের ফিরিয়ে নিয়ে যাবে অনেক গুলো বছর পিছনে, ভুলে যাওয়া শৈশবে। তারা মনে মনে আবার শিশু হোয়ে পড়বে। ধুলোয় লুটোপুটি কোরে খেলা কোরবে। আর খেলার প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যেই নিমেষের জন্য থেমে পার্কের সিটে বসে থাকা দাদু বা দিদার দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত হোয়ে নেবে – “আছে তো?...” ... “চলে যায়নি তো ?” ...

আপনি যদি পাঠিকাহন তাহলে এতক্ষণে নিশ্চয়ই আমায় দিদা বা ঠাম্মি, আর পাঠক হলে দাদু বা ঠাকুর্দা গোছের কেউ একজন ভেবে নিয়েছেন, জানি। আপনাকে জানাই, এই ভুল শুধু আপনি একাই করেন নি, শিশু উদ্যানের বেঞ্চটাও নিশ্চয়ই প্রথমদিন আমায় দাদু  ভেবেছিল। এখন অবশ্য চিনে গেছে। কারন এই দাদু-নাতি-উদ্যানের একমাত্র বেমানান বেখাপ্পা ব্যতিক্রমী চরিত্র আমি। বিশ আর ত্রিশের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে, আমি এদিকেরও নই, আমি ওদিকেরও নই। আমি শৈশব আর প্রৌঢ়ত্বের ঠিক মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে দুই পক্ষেরই লীলা দেখছি। আর আশ্চর্যতম ব্যাতিক্রম হওয়ার ফল – এখানে আমায় সবাই চেনে। সবাই ভালোবাসে। কেউ একা বসে আছে দেখলে তার সাথে গিয়ে কথা বলি, গল্প কোরি। মাঝে মাঝে বাচ্ছাদের সাথে খেলা কোরি। আবার কখনও বা এমনি একা একা চুপচাপ বসে বসে শান্তি উপভোগ কোরি, যা মাথায় আসে ভাবি, ইচ্ছা হলে লিখেও রাখি। কল্পনায় হারিয়ে যাই, মনে মনে ...

লেখা থামিয়ে, পেনটা পাতার মধ্যেই রেখে ডায়রীটা বন্ধ কোরে অমনযোগী হোয়ে দুরের দিকে তাকিয়ে বসে আছি আর বাচ্ছাদের খেলা দেখছি। দেখলাম আমার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে একটা ছেলে মন দিয়ে বাচ্ছাগুলোর খেলা দেখছে। খুব মন দিয়ে দেখছে, যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু পর্যবেক্ষণ করছে। কাছে গিয়ে দেখলে হয়ত চিন্তার দু-চারটে ভাঁজ-ও দেখতে পাবো কপালে। দূর থেকে যেটুকু দেখা যাচ্ছে সেটুকু এইরকম, পরনে আকাশী পাঞ্জাবী ও ধূসর জিন্স। পাঞ্জাবী প্রায় হাঁটুর নীচ অবধি। বয়স আমার-ই ধারে কাছে হবে। চুলগুলো আপন আপন মর্জিমত বিন্যস্ত – ওরা সবাই রাজা - স্বাধীন ও এলোমেলো। মন প্রশ্ন করলো – “কে এই স্বাধীন কেশবান কেকেতন ?”
হ্যাঁ ঠিক, আপনারই মত আমিও মনকে পালটা প্রশ্ন করলাম “কেকেতন মানে কি?”
মন
একটু ভেবে বলল, “জানি না, নতুন শব্দ, পরে ভেবে বলব... আপাতত ডিক্সানারীতে যোগ কোরে নাও... Add to dictionary…

হঠাৎ ছেলেটার মাথায় কি খেলল কে জানে, ছেলেটা সোজা চলে গেলো উদ্যানের দূরতম প্রান্তের বসার জায়গাটার পিছনে। ওদিকটার ঘাস আগাছাগুলো একটু জঙ্গল মত হোয়ে যাওয়ায় ওই সীটটায় কেঊ আর বসতে যায় না। মশা কামড়ায়। ছেলেটা ওই সীটটার পিছন দিকে নিচু হোয়ে কি য্যানো করতে লাগলো। আমি সন্দিগ্ধ দৃষ্টি দিয়ে সেই দূরের দিকে তাকিয়ে দেখছি – যেন আমি একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ডিটেকটিভ। কি করছে কেকেতন টা? পাগল নাকি? আতঙ্কবাদী না তো? বোম টোম লাগাচ্ছে না তো? না না, হাত তো খালি-ই ছিলো। ঘাস কাটার লোক ও হোতে পারে। এইভাবে একের পর এক কাল্পনিক পরিচয় জুড়ে জুড়ে দেখছি কোনটা আমাদের অজ্ঞাত কেকেতনের সাথে ভালো মানায়। এমন সময় কানের ঠিক পাশ দিয়ে বন্দুকের গুলির মত ধাঁ কোরে একটা প্রশ্ন চলে গেলো। চমকে উঠে তাকালাম। দেখলাম একজন প্রৌঢ় ব্যাক্তি কখন আমার পাশে এসে বসেছেন। সাদা পাঞ্জাবী, সাদা ধুতি। মাথা ভর্তি সাদা চুল। তিনি-ই আমার দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে প্রশ্ন করেছেন,
ভালো আছো ?
আমিও হেসে বললাম, হ্যাঁ, ওই আর কি, চলে যাচ্ছে।

‘হ্যাঁ ভালো আছি’ বললে কিছুটা মিথ্যে বলা হোয়ে যেতো। আর সত্যি সত্যি কেমন আছি সেটা যদি আমি ভাবতে বসতাম, তাহলে উনি নিশ্চয়ই ভাবতেন যে আমি সমাধিস্ত হোয়েছি এবং পাশ থেকে উঠে চলে যেতেন। তাই আমি এইরকম একটা মাঝামাঝি উত্তর দিয়ে কাজ চালালাম। আর তাছাড়া ‘কেমন আছো’ জাতীয় ‘আপাত-সহজ-কিন্তু-অত্যন্ত-জটিল’ প্রশ্নগুলো মানুষ প্রায়শঃই কোরে থাকে বটে। কিন্তু প্রকৃত উদ্দেশ্য থাকে খুব-ই সহজসরল – কথোপকথন শুরু করা। কেন যে করে, তার থেকে সহজভাবে বললেই হয় যে – আসুন দুটো গল্প কোরি... এগুলো পাঠকের জন্য লিখলাম, কিন্তু এইসময় আমার এত ভাবার সময় কোথায়? তাই বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না কোরে প্রত্যুত্তরে প্রশ্ন করলাম,
আপনি ভালো আছেন তো?

হ্যাঁ ভাই, আমি কিন্তু দিব্যি আছি। তোমার এই জোয়ান বয়সে ‘হ্যাঁ, চলে যাচ্ছে’ মার্কা জীবন দশা হলেও, আমি কিন্তু এই বয়সেও জীবনটাকে চলে যেতে দিচ্ছি না। শক্ত হাতে ধরে রেখেছি সময়ের লাগাম।
শেষ লাইন টা বলার সময় তিনি হাত তুলে মুঠো শক্ত কোরে দেখালেন। এতটা বলে তিনি একটু থামলেন। মুখে সদা হাসি টা ধরে রেখেছেন। একটা অদ্ভুত স্নেহমাখা হাসি। আমিও হাসিমুখে কখনো মাথা নিচু কোরে, কখনো বা তাঁর দিকে তাকিয়ে সম্মতি জানিয়ে তাঁর কথা শুনতে লাগলাম। তিনি আবার বললেন,

আমার বয়স কত হোলো জানো? সেভেনটি টু। বাট আই অ্যাম স্টিল স্ট্রং । নানারকম কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছি। এই উদ্যানের ক্লাব কমিটিতে আছি। আজ সকালে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মিস্ত্রীদের দিয়ে ওই মেন গেটের মাথায় ওই বোর্ডটা লাগিয়েছি।  দেখেছো নিশ্চয়ই...

আমি একটু অপ্রস্তুত হোয়ে বললাম, না... মানে ঠিক খেয়াল কোরি নি...

সে ঠিক আছে। বেরোনোর সময় দেখে নিও। আগে বুঝলে, গেটের বাঁ দিকের পিলারটায় পার্কের নামটা লেখা ছিলো, একটা মার্বেল এর ওপর কালো কালি দিয়ে। তা সেটার ওপর এমন-ই ধুলো পড়ে গেছে, যে  এখন আর কেউ এই উদ্যানের নামটাই জানে না। তাই ভাবলাম, ঢোকার গেট এর মাথাতেই যদি আর্চ কোরে বড় বড় কোরে নামটা টাঙ্গানো থাকে, তাহলে সবার চোখে পড়তে বাধ্য... কি বলো ? আমাদের এত প্রিয় একটা জায়গার পরিচয় তো আর এইভাবে হারিয়ে যেতে দেওয়া যায় না... ?

আমি সম্মতি জানিয়ে বললাম, হ্যাঁ, তাই তো...

তারপরই হঠাৎ বৃদ্ধের মনে কি খেয়াল জাগলো। বিদ্যুৎ বাণ ছুঁড়ে দিলেন আমার দিকে। চোখে তাঁর কনফিডেন্স। যেন জানেনই, যে এ বাণ অব্যার্থ।
আচ্ছা, তুমি বলো দেখি এই পার্কটার নাম কী?

হে ভগবান, এই প্রশ্নটাই ওনাকে করতে হোলো ? ওনার কথা শোনার পর ভেবেছিলাম আজ বেরনোর সময় নামটা দেখে নেবো। এই পার্কটার যে একটা নাম আছে, তাই বা কে জানত।

আমি ধরা পড়ে যাওয়ার মত মুখ কোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। তাই দেখে বৃদ্ধ হো হো কোরে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন “চাপ নিও না” এবং ততক্ষণাৎ ডান হাতের তালুর উল্টোদিক দিয়ে মুখটা আংশিক ঢেকে, গোপন কথা বলার ভঙ্গিমায় মুখ তা একটু কাছে এনে বললেন – এই ভাষাটা অবশ্য নাতির থেকে শেখা, তোমাদের জেনারেশন এরই ভাষা” ... বললেই আবার হো হো কোরে হাসতে লাগলেন। যেন খুব বড় চোর ধরেছেন। বিজয়গর্ব কে আর কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারছেন না। তারপর, অনেক কষ্টে হাসি চেপে বললেন,
চাপ নিও না বৎস। এ উদ্যানের নাম “জগতিক উদ্যান”। বুঝলে?
আমি সংক্ষেপে বললাম,  হুমম...
বৃদ্ধ। তা, নামটা কেমন বলো?
আমি। ভালোই। একটু কেমন অদ্ভুত মতন...
বৃদ্ধ। হ্যাঁ, তা মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। যদি না ঈঙ্গিত টা ধরতে পারো তো...

আমি অবাক ও কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম – কী ঈঙ্গিত?

বৃদ্ধ। এই নামটা এটাই ঈঙ্গিত করছে যে, এই সমগ্র জগৎটাই যেন একটা বৃহৎ উদ্যান, খেলাঘর, প্লে-গ্রাউণ্ড। এখানে সবকিছুই আসলে খেলা।
এতটা বলে তিনি এপ্রসঙ্গে আমার কী বলার আছে তা জানার দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকালেন।
আমি বললাম, আর খেলা। কাজ করতে করতে দিন রাত সব এক হোয়ে যাচ্ছে। যা চাপ অফিসে...

বৃদ্ধ মৃদু হেসে বললেন, এখন বুঝতে পারবে না। তোমার যে এখনও অনেকটা পথ চলা বাকি, অনেক কিছু শেখা বাকি। আর তারপর একদিন যখন আমার মত বয়স হবে, তখন বুঝবে সবকিছুই আসলে খেলা...
তোমার চারিদিকে তাকিয়ে দেখো। এই উদ্যান শিশু আর বৃদ্ধদের জন্য। শিশু, যারা সরল ও নিষ্পাপ। তাদের কাছে পুরোটাই খেলা। খেলা ছাড়া তারা আর কিছু জানে না। বোঝে না। আর বৃদ্ধ, যারা জীবনের সমস্ত ঘাত-প্রতিঘাতের চড়াই-উতড়াই ও ঢেউ পেরিয়ে এসে এখন শান্ত হোয়েছেন। এবং জেনেছেন, কিছুই চিরস্থায়ী নয়। যা কিছু তুমি গড়বে, একদিন তা ভেঙ্গে যাবে। যাকিছু তুমি পাবে, তা আবার হারিয়ে যাবেযা কিছু এই জগৎ থেকে নেবে, তা একে একে আবার এই জগৎ এই ফিরিয়ে দিতে হবে। আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করলেই দুঃখ। আর এইভাবে তারা শিখেছেন সুখী হওয়ার মূল রহস্য – নির্লিপ্ততা। আর তাই কোনোকিছুকেই তারা খুব সিরিয়াসলী নেন না বা গায়ে মাখেন না। উদাসী ভাব নিয়ে চলেন। কারন তারা তাদের সমগ্র জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে উপলব্ধি করেছেন – পুরোটাই আসলে খেলা।

এতটা বলে বৃদ্ধ ভদ্রলোক একটু থামলেন। তাকে আগের থেকে অনেক বেশী শান্ত লাগছে। গলার স্বরের মধ্যেও একটা অদ্ভুত শান্তভাব লক্ষ্য করলামহয়তো কথাগুলোই এরকম ছিলো, যা মানুষকে শান্ত কোরে দেয়।

কিছুক্ষণ থেমে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কি বুঝলে?
আমি একটু ভেবে বললাম, বুঝলাম যে জীবন নদীর একদিকে অর্থাৎ শুরুর দিকে দাঁড়িয়ে আছে শিশুরা। তারা এখনও নদীতে নামে নি, আর স্রোতে পা-ও দেয়নি, তাই দিব্যি মজায় আছে। আর অপরদিকে অর্থাৎ শেষের দিকে রয়েছেন আপনারা, যেখানে সব স্রোত শেষ হোয়ে গেছে। তাই আপনারা বেশ মজাতেই আছেন। আর মাঝখানে পড়ে কাজের চাপে হাবুডুবু খাচ্ছি আমরা। এইরকম ব্যাপার আর কি... – বলে আমি স্বল্প হাসি দিয়ে বিরতি নিলাম। আমার ব্যাখ্যা শুনে তিনি পুনরায় সেই আগের মত জোরে হেসে উঠলেন, এবং তারপর বললেন,

ওকে ইয়ং ম্যান, চালিয়ে যাও। কাজ কোরছো করো। কিন্তু এই বৃদ্ধের কথা গুলো ও মনে রেখো একটু। কোনোকিছুতেই নিজেকে খুব বেশী জড়িয়ে ফেলো না। ঠিক আছে? আমি উঠি এবার, ক্লাবে যেতে হবে একটু... আমি মাথা নেড়ে সায় জানালাম। বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি শেষ কথাগুলো বলার সময় আমার কাঁধ চাপড়ে দিলেন। এবং তারপর বিদায় নিলেন।

অন্ধকার হোয়ে এসছিলো। সাতটা বাজে প্রায়। আমিও উঠলাম...


* * *

বাড়ি ফেরার পথে দেখলাম মোড়ের মাথার একটা ডাস্টবিনের কাছে গুণ্ডি মরে পড়ে আছে। গুণ্ডি রাস্তার একটা কুকুর। ওর জন্ম আমাদের এ উঠানে। বেশি দিন না, আজ থেকে খুব বেশি হলে পাঁচ বছর হবে।ছোটোবেলায় বেশ গোলগাল, নাদুসনুদুস ছিলো। ওর আগে ওর মা আমাদের সামনের রাস্তাটায় থাকতো। রোজ রাতে এবং অনেকদিন দুপুর বেলাও ওর মা কে আমাদের উঠানে খেতে দেওা হত। তারপর ও যখন বড় হোয়ে যায়, তখন ওটা ওর এলাকা হোয়ে যায় এবং ওর মা কে ও পাড়া ছাড়া করে দেয়। বেশি রাত্রিবেলা কোথাও থেকে ফেরার সময়, পাড়ায় ঢোকা মাত্র যখন অন্য কুকুরগুলো চেঁচামেচি শুরু করত, তখন গুন্ডি কোথা থেকে দৌড়ে এসে আমাদের পাশে পাশে হাঁটতে থাকতো এবং পাহারা দিয়ে বাড়ি অব্ধি যেতো। ওর আবদার এর ও শেষ ছিলো না। বাড়িতে তো বিস্কুট খেতোই, আবার বাবা, মা বা আমি, যে-ই দোকানে যেতাম, গুণ্ডি ও সাথে সাথে লেজ নাড়তে নাড়তে চলত। আনন্দে গায়ে লাফালাফি করত, দু পায়ে দাঁড়িয়ে পড়ত। ওর দু খানা বিস্কুট চাই...

সেই গুণ্ডি আজ মৃত। আমার চোখে জল এলো। আমরা সবাই খুব ভালবাসতাম গুণ্ডিকে। দেখলাম গুণ্ডির মা এসে পাশে বসে আছে। ওর ও নিশ্চয়-ই আজ খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি আর দাঁড়ালাম না ওখানে। মাথা নিচু কোরে বাড়ির দিকে হাঁটা লাগালাম। আর ভাবতে লাগলাম। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে গুণ্ডির কোনো অস্তিত্ব ছিলো না। আর আজ আবার গুণ্ডি ‘নেই’ হোয়ে গেলো। কত তুচ্ছ, কত নশ্বর, কত ক্ষণস্থায়ী এই জীবন। ঠিক-ই বলেছেন ওই বৃদ্ধ। এই জীবনটা একটা খেলা মাত্র। নাহলে এর মধ্যে যদি এতটুকু সিরিয়াস কিছু থাকত, তাহলে কি এত সহজে সবকিছু শেষ হয়ে যেতে পারতো? মানুষ তার সারা জীবন লাগিয়ে দেয় তার নিজের পরিচয় গড়ার জন্য। মানুষ যখন বেঁচে থাকে, তখন নিজেকে কি ইম্পর্ট্যান্ট-ই না মনে করে। তারপর একদিন হঠাৎ সব শেষ হোয়ে যায়। ব্যাস! সে ভ্যানিশ। তার নাতি-নাতনী, বা বড়জোর সেই নাতি-নাতনীর ছেলে মেয়েরা তাকে মনে রাখে। ততদিন তা-ও মানুষের মনে মনে তার অস্তিত্ব বা অস্তিত্বের ছায়াটুকু থাকে। আর তারপর? তারপর, তার মৃত্যুর ঠিক এক’শ বছরের মধ্যেই এমন একটা দিন আসে, যখন পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকা প্রত্যেকটি মানুষের মনে তন্য তন্য কোরে খুঁজেও তার কোনো হদিস পাওয়া যাবে না। সে যে তাদের-ই মত কোনোদিন এই পৃথিবীতে বেঁচে ছিলো, সেটা আর কারোর জানা নেই। যেমনভাবে ব্ল্যাক-বোর্ডের ওপর থেকে ডাস্টার দিয়ে লেখা মুছে ফেলা হয়, ঠিক তেমনভাবেই মানুষকে মুছে ফেলা হয় খেলার শেষে। প্রকৃতপক্ষে, এই জগতের কোনো জিনিষের ওপর-ই মানুষের কোনো অধিকার নেই। সে যতই ‘আমার আমার’ করুক না কেন। সে যদি তার মৃত্যুর এক’শ বছর পর, আবার কোনোভাবে মৃত্যুর আগের চেহারা নিয়ে ফিরে আসতে পারতো, তাহলে দেখতো, তার প্রিয় জিনিষপত্র তো দূরে থাক, তার পরিচয়টুকুও তাকে ফেরত দিচ্ছে না, এমনকি তাকে চিনতেও পারছে না – তার-ই বংশধররা...


* * *



কম্পিউটারে বসে কাজ করতে করতে দেখলাম রাত দুটো বাজে। ঘুম-ও পাচ্ছিলো খুব। রবিবার শেষ, ছুটি শেষ, আবার কাল থেকে কাজ শুরু। আমার প্রিয় নীল ডায়রীকে মাথার কাছে রেখে শুয়ে পড়লাম। বেড সুইচ দিয়ে আলো টা নিভিয়ে দিলাম। আহ্! কি আরাম, ঘুমের মত জিনিস নেই...
* * * 

 - সুমন বারিক



No comments:

Post a Comment